ঢাকা,  রোববার  ২৬ অক্টোবর ২০২৫

নিউজ জার্নাল ২৪ :: News Journal 24

ন্যায় ব্যর্থ হলে শক্তিশালী রাষ্ট্রও ভেঙে পড়ে : প্রধান বিচারপতি

নিউজ জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৮:০০, ২৫ অক্টোবর ২০২৫

ন্যায় ব্যর্থ হলে শক্তিশালী রাষ্ট্রও ভেঙে পড়ে : প্রধান বিচারপতি

প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, ‘ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্র দৃঢ় হয়, ন্যায় ব্যর্থ হলে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রও ভেঙে পড়ে। আইন কেবল নিয়মের সমষ্টি নয়, এটি জাতির নৈতিক বিবেকের প্রতিফলন। যখন রাষ্ট্র নাগরিকদের মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তাদের কণ্ঠরোধ করে, তখন ন্যায়ের জন্য লড়াই করা নৈতিকভাবে অপরিহার্য।’

শনিবার (২৫ অক্টোবর) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে আইন বিভাগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।

প্রধান বিচারপতি তার বক্তব্যে মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক বিচারব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মানবতা যখন অবিচার ও অমানবিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভয়াবহ পরিণতি প্রত্যক্ষ করে, তখনই মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা মানবজাতিকে নতুন নৈতিক চেতনার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যখন রাষ্ট্র নাগরিকদের মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তাদের কণ্ঠরোধ করে, তখন ন্যায়ের জন্য লড়াই করা নৈতিকভাবে অপরিহার্য।’

বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক আন্দোলনগুলো স্মরণ করিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার জন্য ছিল না; এটি ছিল ন্যায়, মর্যাদা ও অস্তিত্বের অধিকারের সংগ্রাম।

ঠিক একইভাবে ১৯৭১ সালে বাঙালি লড়েছিল মর্যাদা, সমতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য। আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে আমরা কেবল পতাকা বা রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য লড়িনি, আমরা লড়েছি ন্যায়ের জন্য।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী নতুন বাস্তবতার আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে প্রশাসনিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, নৈতিকভাবে সাহসী ও সংবিধানিকভাবে শক্তিশালী বিচার বিভাগ বিনির্মাণ করতে হবে।’

তিনি উল্লেখ করেন, তার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মূল অংশ হলো একটি পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়, যা বিচার প্রশাসনের কেন্দ্রীয় কাঠামো হিসেবে কাজ করবে এবং সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায়বিচারের অভিগম্যতা নিশ্চিত করবে।

মাত্র দুই দিন পূর্বে, ২৩ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর নীতিগত অনুমোদন দেয়। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এই অধ্যাদেশ বিগত ১৫ মাসের সুপরিকল্পিত কৌশলগত প্রচেষ্টা ও বহুপক্ষীয় প্রয়াসের ফল। এই প্রচেষ্টা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।’

প্রধান বিচারপতি অংশীজনদের প্রতি বলেন, ‘সব অংশীজনকে বুঝতে হবে তারা সবাই একটি পারস্পরিক দায়বদ্ধতার (quid pro quo) অংশ।

তাই পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি হতে হবে সহযোগিতা, যুক্তিবোধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীলতা। কোনো ধরনের অবিশ্বাস বা একতরফা আচরণ গত ১৫ মাসের প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা স্বাধীনতা দুর্বল করতে পারে।’

তিনি জেলা আদালতের আইনজীবী সমাজ, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন, জেলা আদালতের বিচারকবৃন্দ এবং বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনসহ সকল অংশীজনকে এই কাঠামোগত রূপান্তর টেকসই করতে আহ্বান জানান।

আইনজীবী, শিক্ষাবিদ ও নবীন আইনস্নাতকদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আইনের অধ্যয়ন কেবল পেশাগত প্রশিক্ষণ নয়, এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সাধনা। প্রত্যেক আইনজীবী ও বিচারককে মনে রাখতে হবে প্রত্যেক আইনের পেছনে একটি জীবন, প্রত্যেক রায়ের পেছনে একটি ভাগ্য রয়েছে। ন্যায়ের প্রকৃত মান নিরপেক্ষ ও মানবিক বিচারে নিহিত।’

তিনি আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর বিচারব্যবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, ‘একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা এখনো ঔপনিবেশিক কাঠামোর উত্তরাধিকার বহন করছি। তাই ডেটা-নির্ভর ব্যবস্থাপনা, ডিজিটাল সংযোগ ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে আমাদের বিচারব্যবস্থা সময়োপযোগী হতে হবে।’

প্রধান বিচারপতি মহোদয় দেশের আইনাঙ্গনের সমৃদ্ধিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান স্মরণ করে বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য প্রাজ্ঞ আইনবিদ তৈরি করেছে। আমি বিশ্বাস করি, এখান থেকে ভবিষ্যতেও এমন আইনজ্ঞ তৈরি হবে, যারা কেবল জ্ঞানে নয়, মানবিকতাতেও আলোকিত হবে।’

তিনি ন্যায়বিচারের পুনর্জাগরণের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, ‘সংবিধানের যে স্বাধীনতা, সমতা ও ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার রয়েছে, তা যেন দেশের প্রতিটি নাগরিকের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায় সেটিই আমাদের দায়িত্ব।’

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক ও বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ, আইনজীবী ও শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।

 

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন