ঢাকা,  বৃহস্পতিবার  ০৯ অক্টোবর ২০২৫

নিউজ জার্নাল ২৪ :: News Journal 24

ভোলার চরে মহিষ পালন: ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণ

মোঃ সামিরুজ্জামান, রিপোর্টার

প্রকাশিত: ১৬:৩৫, ৯ অক্টোবর ২০২৫

ভোলার চরে মহিষ পালন: ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণ

বাংলাদেশের উপকূলীয় দ্বীপ জেলা ভোলা—প্রকৃতির দান, নদীর স্রোত আর চরাঞ্চলের সবুজ ঘাসে ভরপুর এক অনন্য জনপদ। এই জনপদের মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মহিষ পালন। যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় চলে আসা এ পেশা শুধু ঐতিহ্য নয়, এখন তা হয়ে উঠেছে জীবিকা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্বাবলম্বিতার প্রতীক।

ভোলার প্রায় অর্ধশতাধিক বিচ্ছিন্ন চরে প্রায় দুই শতাব্দী ধরে বাতান পদ্ধতিতে মহিষ পালন করে আসছেন চরবাসী। এসব বাতানে দুই শত থেকে শুরু করে এক হাজার পর্যন্ত মহিষ পালন হয়—যা ঘরোয়া পরিবেশে একেবারেই অসম্ভব। অনুকূল আবহাওয়া ও চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ তৃণভূমি মহিষ পালনের জন্য তৈরি করেছে উপযুক্ত পরিবেশ। ফলে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলজুড়ে মহিষ এখন শুধু ঐতিহ্য নয়, হয়ে উঠেছে এক লাভজনক কৃষিখাত।

কালের বিবর্তনে এখন অনেকেই বাতানের পাশাপাশি বসতবাড়ির গোয়ালঘরেও মহিষ পালন শুরু করেছেন। ভোলা সদর, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, তজুমদ্দিন, লালমোহন, চরফ্যাশন ও মনপুরা—এই সাতটি উপজেলাজুড়ে রয়েছে অর্ধশতাধিক বিচ্ছিন্ন চর। সরকারি হিসাবে জেলায় মহিষের সংখ্যা ১ লাখ ২৪ হাজার হলেও স্থানীয় প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যমতে বাস্তব সংখ্যা তিন লাখেরও বেশি। জেলার ৯৭টি বড় মহিষ বাতান ও ৭০৫টি দুগ্ধ খামারে প্রতিদিন উৎপাদিত হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার লিটার দুধ। এসব দুধ থেকে তৈরি দই, মাখন, ঘি, মাঠা ও ঘোল স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এখন দেশের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে যাচ্ছে।

চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ তৃণভূমি মহিষের জন্য প্রাকৃতিক খাদ্যের যোগান দিচ্ছে। এসব চরে হাজার হাজার মহিষ ঘাস খেয়ে বড় হচ্ছে—একেবারেই প্রাকৃতিক উপায়ে। এখানকার বহু পরিবার প্রজন্ম ধরে দুধ ও দই বিক্রির পেশায় নিয়োজিত। স্থানীয় দই ব্যবসায়ী ও খামারিদের মতে, প্রায় দুই শতাব্দী আগে থেকেই ভোলায় মহিষের দুধ থেকে দই তৈরির প্রচলন শুরু হয়। ব্রিটিশ আমল থেকে জনপ্রিয় এই দই আজও ভোলার ঐতিহ্যের অন্যতম অংশ।

চর মোহাম্মদ এলাকার খামারি মো. জালিল হাওলাদার বলেন, “আমার ৪১টি মহিষ রয়েছে। এই খামার থেকেই সংসার চলে, জমি কিনেছি, সন্তানদের পড়ালেখা করাচ্ছি। তবে বর্তমানে চরে মহিষের চারণভূমি কমে যাওয়ায় পালন করতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে।”

চর কালির বাতান মালিক মো. জাকির দেওয়ান জানান, “আমাদের পরিবারের তিন পুরুষ ধরে মহিষ পালন চলছে। এখন কৃমিনাশক ও ভ্যাকসিন ব্যবহারে মৃত্যুহার কমেছে, আর দুধ ও মাংসের দাম বেড়েছে। ফলে মহিষ পালন এখন আগের চেয়ে অনেক লাভজনক।”

ভোলা সদর উপজেলার চর চটকিমারার বাতান মালিক মো. আনোয়ার বলেন, “আমাদের বাতানে রয়েছে আড়াই শতাধিক মহিষ, যা চার পুরুষ ধরে পালন করছি আমরা। প্রতিদিন এখান থেকে গড়ে ১৫০ কেজি দুধ উৎপাদিত হয়।”

ভোলায় মহিষের দুধ থেকে বছরে প্রায় ২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন দই উৎপাদিত হচ্ছে। স্থানীয় বাজারে মহিষের দইয়ের চাহিদা দিন দিন বেড়ে চলেছে। দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের ‘টালির দই’ এখন সবচেয়ে জনপ্রিয়। দেড় কেজি দই বিক্রি হয় ২৫০ টাকায়, আর দুই কেজির দাম প্রায় ৩০০ টাকা। এই দই থেকেই তৈরি হয় মাখন, ঘি ও ঘোল। মাখনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকায়, আর ঘি বিক্রি হচ্ছে ১,৬০০ থেকে ১,৮০০ টাকায়। ফলে দুধের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দই ব্যবসায়ীরাও পাচ্ছেন ভালো লাভ।

মহিষ পালন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভোলায় কাজ করছে গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থা (জিজেইউএস)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন মহিন বলেন, “মহিষের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য এই এলাকায় আরও কিল্লা (আশ্রয়স্থল) প্রয়োজন। এছাড়া অসচেতন প্রজননের কারণে মহিষের জাত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যা পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।”

ভোলা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম খান বলেন, “সরকারি হিসাবে ভোলায় বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার মহিষ রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদিত হচ্ছে। এসব ‘জলা মহিষ’ জাতের হলেও আমরা এখন উন্নত মুদ্রাজাত মহিষ প্রজননের কাজ করছি। আমাদের ৩৪ জন মাহিষ এআই কর্মী কাজ করছে। ইতিমধ্যে ৭৯৬টি মহিষকে কৃত্রিম প্রজনন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ২৩৬টি বাচ্চা পাওয়া গেছে। এগুলোর মাধ্যমে উন্নত জাতের মহিষ উৎপাদনের কাজ চলছে।”

তিনি আরও জানান, “ডিএলআরই ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে আধুনিক মহিষ প্রজনন খামার স্থাপনের জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ প্রেরণ করা হয়েছে। একটি চরকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে নিয়ে চারণভূমি উন্নয়নের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ভবিষ্যতে ভোলার খামারিরা আরও বেশি দুধ উৎপাদনে সক্ষম হবেন।”

সব মিলিয়ে, দ্বীপ জেলা ভোলার চরাঞ্চলে মহিষ পালন শুধু ঐতিহ্যের ধারক নয়, বরং দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের এক অনন্য অধ্যায়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চরবাসীর ঘাম, অভিজ্ঞতা ও ভালোবাসায় গড়ে ওঠা এই মহিষ খাত এখন ভোলাকে দিচ্ছে আত্মনির্ভরতার নতুন পরিচয়—একটি জীবন্ত উদাহরণ, কীভাবে ঐতিহ্য ও উন্নয়ন একসাথে পথ চলতে পারে।

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন