বাংলাদেশের রাজনীতির এক দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আর নেই। মঙ্গলবার ভোর ছয়টায় রাজধানীর বসুন্ধরায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে লিভার ও কিডনি জটিলতা, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আথ্রাইটিসসহ নানা দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল রোগে ভুগছিলেন। গত ২৩ নভেম্বর তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালে ছুটে যান। মৃত্যুর আগে রাত দুইটার পর হাসপাতালের সামনে এসে অধ্যাপক জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, খালেদা জিয়া অত্যন্ত সংকটাপন্ন সময় পার করছেন এবং তার সুস্থতার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছিলেন। কয়েক ঘণ্টা পর হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মৃত্যুর সময় হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন তার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তার স্ত্রী জুবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা রহমান, প্রয়াত ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান, নাতনি জাহিয়া রহমান ও জাফিয়া রহমান, ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার ও পরিবারের অন্য সদস্যরা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুতে হাসপাতালে শোকের আবহ তৈরি হয়; চিকিৎসক ও নার্সদের অনেককে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়। মুহূর্তের মধ্যেই শোক সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, যেখানে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ শোক প্রকাশ করেন।
নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় আপসহীন অবস্থানের কারণে খালেদা জিয়া পরিচিতি পান ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে। তার রাজনৈতিক জীবনের বড় অংশ কেটেছে রাজপথের আন্দোলন, গ্রেপ্তার ও কারাবাসের মধ্য দিয়ে। তিনি একাধিকবার কারাগারে গেছেন, তবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে কখনো পরাজয়ের মুখ দেখেননি—এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল এক নজির।
১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট অবিভক্ত ভারতের জলপাইগুড়িতে জন্ম নেওয়া খালেদা জিয়ার পারিবারিক নাম ছিল খালেদা খানম, ডাকনাম পুতুল। দেশভাগের পর পরিবারসহ দিনাজপুরে বসবাস শুরু করেন তিনি। সেখানেই তার শিক্ষাজীবনের বড় অংশ কাটে। ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পরে স্বামীর কর্মস্থলের কারণে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানেও থাকতে হয়।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করেন। ১৯৮১ সালে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হলে রাজনীতিতে সক্রিয় হন খালেদা জিয়া। তখন তিনি ছিলেন রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ এক গৃহবধূ। ১৯৮৩ সালে তার নেতৃত্বে বিএনপি সাতদলীয় জোট গঠন করে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নামে। অন্য অনেক রাজনৈতিক দল সমঝোতার পথে গেলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি কোনো আপসে যায়নি। সেখান থেকেই দলের ভেতরে ও বাইরে তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবকটিতে বিজয়ী হন খালেদা জিয়া। বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি হন বাংলাদেশের প্রথম এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে আবারও জয়ী হন। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার গঠন করে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন।
২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার সময় খালেদা জিয়া ও তার বড় ছেলে তারেক রহমান গ্রেপ্তার হন। এক বছর পর মুক্তি পেলেও রাজনৈতিকভাবে বিএনপির জন্য সময়টি ছিল কঠিন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলটি ভরাডুবির মুখে পড়ে এবং এরপর আর ক্ষমতায় ফিরতে পারেনি।
২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাগারে যান খালেদা জিয়া। ২০২০ সালে নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পেলেও তাকে গুলশানের বাসায় থাকতে হয় এবং বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি পাননি। দীর্ঘদিন কার্যত গৃহবন্দি অবস্থায় তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় এবং বড় ধরনের অস্ত্রোপচারও করতে হয়।
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। ওই বছরের ৭ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে তিনি মুক্তি পান এবং পরে উচ্চ আদালতে মামলাগুলো থেকে খালাস পান। তবে অসুস্থতার কারণে আর সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরতে পারেননি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান এবং বহু বছর পর বড় ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে তার দেখা হয়।
সবশেষ গত ২১ নভেম্বর ঢাকায় সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল খালেদা জিয়াকে। এর মাত্র ৩৯ দিনের মাথায় তার মৃত্যুর খবর এলো। তার বিদায়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সৃষ্টি হলো এক গভীর শূন্যতা, যা দীর্ঘদিন আলোচিত হয়ে থাকবে।









